বরিশাল সদর উপজেলা ছাত্রলীগের বিতর্কিত সাধারন সম্পাদক আশিকুর রহমান সুজন একের পর এক বিতর্ক জন্ম দিয়েও ধরাছোঁয়ার বাহিরে রয়েছেন। প্রশাসনের উর্দ্বতন কর্মকর্তাকে কটুক্টি, দলীয় নেতাকর্মীদের মারধর, সরকারী কর্মকর্তাদের মারধর, বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ অপার্জনসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছেন সুজনের বিরুদ্ধে।
সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক সুজন কয়েকদিন পরপরই নানা ঘটনা জন্ম দিয়ে নিজেকে আলোচনায় রাখতে পছন্দ করেন। একের পর এক বিতর্কিত কাজ করে বিতর্কিত ছাত্রলীগ নেতা হিসেবেও খেতাব পেয়েছেন তিনি। সূত্র জানায়, বছরের পর বছর ধরে সদর উপজেলায় একক অধিপত্য বিস্তার করে নানা অপকর্ম করে আসছেন সুজন। বরিশাল-ভোলা মহাসড়কেও রয়েছে তার চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট। তার এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই তাকে পরতে হয় রোষানলে।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকায় পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের কর্মীদের মারধর করার অভিযোগ উঠেছে সুজনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। জানা যায়, সুজনের নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ ওই সাবস্টেশন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখার কারন জানতে চান। এ সময় অফিসে উপস্থিত দায়িত্বরত লাইনম্যান জাফর ইকবাল এর ব্যাখ্যা দিলেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি সুজন বরং উত্তেজিত হয়ে একপর্যায়ে মারধর করেন। জাফর ইকবালকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে সহকর্মী মাহফুজুর রহমান, পরিতোষ চন্দ্র পাল এবং সুমন, তারাও রেহাই পায়নি সুজনের হাত থেকে। সেদিন সন্ধ্যায় গুরুতর আহত জাফর ইকবালকে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে দাপ্তরিক মিটিং এ সুজনের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তারা বন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন।
গতবছর বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সাথে গণভবণ থেকে ভিডিও কন্ফারেন্সে করোনা পরিস্থতি নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারী নিয়মানুযায়ী বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন জেলা প্রশাসক এস,এম অজিয়র রহমান। সেখানে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, বিভাগীয় কমিশনার ইয়ামিন চৌধুরী, রেঞ্জ ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বিপিএম বার-পিপিএম, পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বিপিএম-বার সহ প্রশাসনের উর্দ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্য জায়গার মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুমতি প্রার্থণা করেন জেলা প্রশাসক, যে আপনি যার সাথে কথা বলতে চাইবেন আমি তার কাছেই দিবো। পরে প্রধানমন্ত্রী বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশ কমিশনারের সাথে কথা বলে বরিশালের সার্বিক দিক সম্পর্কে জানেন। এই অনুষ্ঠান শেষে যুবরত্ন হিসেবে খ্যাত বিসিসি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচে উপস্থিত সকলের সাথে কুশল বিনিময় করেন এবং নগরীর খাবার সংকটে থাকা মানুষের মাঝে খাবার পৌঁছে দেয়া নিয়ে তার কার্যক্রম সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলেন। এই পুরো ঘটনাকে অন্যদিকে মোড় দিতে সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান সুজন তার ব্যক্তিগত ফেসবুক লাইভে আসেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করে বলেন যে বিসিসি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে নিয়ে জেলা প্রশাসক কোনো ধরনের প্রশংসা করেন নি প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এই অভিযোগ করতে গিয়ে তিনি বরিশালের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমানকে ‘আহাম্মক’ বলেও অভিহিত করেন। এমনই একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল ফেসবুকে।
প্রিয় পাঠক শুধু এই ঘটনাই নয়, সুজনের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও একাধিক অভিযোগ। একটু পিছনে ফিরে তাকাতে চাই ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর বেশ কিছু গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিলো এমন ‘বরিশাল ছাত্রলীগ নেতা সুজনের প্রকাশ্য সন্ত্রাস, থানায় জিডি’ হ্যা সুজনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ছাত্রলীগ কর্মী সিদ্দিকও। ‘বরিশাল জুড়ে ছাত্রলীগ নেতা সুজনের ত্রাস, সহিষ্ণু শহরে শুরু হলো রাজনৈতিক সন্ত্রাস’ এটি গত বছরের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহের কিছু গণমাধ্যমের শিরোনাম। এরকম বহু বার নানা কর্মকান্ড করে নিজেকে তথা ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করছেন সুজন।
সর্বশেষ বরিশালে এক ছাত্রলীগ নেতাকে হাতুড়ি পেটার ঘটনায় বিতর্কিত ছাত্রলীগ নেতা সুজনসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সূত্র জানায়, গত ১৫ মে শনিবার সন্ধ্যার পর বরিশাল সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক আশিকুর রহমান সুজন তার সহযোগীদের নিয়ে সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়ার মোল্লাবাড়ি স্ট্যান্ডে লিটনের ইলেকট্রিক দোকানে হামলা চালায় এবং তাকে মারধর করে। মোল্লাবাড়ি স্ট্যান্ডে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার ছাত্র ফেডারেশনের সদর উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ছাত্রলীগ কর্মী রাহাতের সঙ্গে সুজনের দেখা হয়। ওই সময় তার লোকজন রাহাতকে মারধর করে এবং সুজন হাতুড়ি দিয়ে তাকে পিটিয়ে আহত করে। রাহাতকে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ধলু মোল্লা আহতের বরাত দিয়ে জানান, সুজনের আত্মীয় তুহিনের কাছে রাহাত কয়েক লাখ টাকা পায়। টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে আজকের এ ঘটনা।
প্রত্যক্ষ দর্শী মনির মোল্লা জানান, সুজন আর রাহাত বন্ধু, সুজনের লাহারহাটের টাউটারি ব্যাবসায় রাহাত সহ অনেকে মিলে ১০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করে। সেই টাকা ফেরত চাওয়া নিয়ে শত্রুতা শুরু হয়। এর ভিতরে সুজন বিয়ে করেছে তা এলাকাজুড়ে মানুষ জেনে গেছে। বিয়ের সময় রাহাত উপস্থিত ছিলো তাই ওকে সন্দেহ করে। সেখান থেকেই এই হামলা। হামলার আগে সুজন হুন্ডার বহর নিয়ে মোল্লাবাড়ি স্টান্ডে এসে দোকান ভাংচুর করে। এরপর রাহাতের উপর হামলা করে। প্রথমে সুজন হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এতে সামান্য ক্ষতি হয় রাহাতের। সাথে সাথে নিজেকে বাঁচাতে রাহাত সামনের দিকে অগ্রসর হলে সুজনের শ্যালক শুভর হাতুড়ির আঘাতে গুরতর আহত হলে রাহাত বেহুঁশ হয়ে পরে।
বরিশাল সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান সুজন অভিযোগ অস্বিকার করে বলেন, ভোলার তুহিন নিঁখোজ, সেবিষয়ে রাহাতকে জিজ্ঞেস করি আমি। এতেই রাহাত ক্ষিপ্ত হয়ে ফেসবুকে নানান স্টাটাস দিতে থাকে এবং আমি বিবাহিত না হওয়ার পরেও সকলকে বলে বেরায় আমি বিবাহিত। রাহাত বন্ধু হওয়ায় তাকে ফেসবুকে মিথ্যাচার না করতে বলি। এরপর সে সন্ধ্যায় আমার উপর হামলা চালায়। আর হামলা চালাতে গিয়ে সে নিজেই রাস্তার উপর পরে আহত হয়ে আমার বিরুদ্ধে উল্টো মিথ্যাচার করছে। তার সঙ্গে আমার কোনো লেনদেনও নেই। এ বিষয়ে আমিও আইনের আশ্রয় নিব।’
এদিকে রাহাতের উপর হামলার ঘটনায় রাতেই বন্দর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রাহাতের বাবা খবির ডাক্তারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ নেতা সুজনসহ ৬জনকে আসামী করে ও অজ্ঞাত ২০/২৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা গ্রহণ করে (মামলা নং-৬)। এবং সেই মামলায় সুজনের অনুসারী রুবেল ও মেহেদীকে গ্রেফতার করে বন্দর থানা পুলিশ।
এদিকে মামলার এজাহারে সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আশিকুর রহমান সুজনের শ্যালকের নাম উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে তাকে বিবাহিত বলা হলেও, সুজন দাবি করেছেন তিনি অবিবাহিত। যা নিয়ে সুজনের নিজ এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
বন্দর থানার ভারপাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন তালুকদার বলেন, রাতে সংঘাতের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। এবং রাহাতের বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে এবং দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল থেকে আমি বিষটি সুষ্ঠ তদন্তের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি উর্দ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে বাকি আসামীদের গ্রেফতারের জন্য আমরা অভিযান অব্যহত রেখেছি।’ আহত রাহাতের পরিবারের সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ওসি আনোয়ার হোসেন তালুকদার আরও বলেন, ‘অপরাধী সে যেই হোক কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।’
অন্যদিকে রেনু পোনার সিন্ডিকেট সহ নানা অবৈধ কাজের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রনের অভিযোগও রয়েছে সুজনের বিরুদ্ধে। গত বছর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ সহ নানা অভিযোগে তাকে সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক পদ থেকে বহিস্কার করা হয়। বহিস্কারের পরে বরিশাল সদর উপজেলাবাসীদের মধ্যে স্বস্থি ফিরে এলেও চলিত বছরে আবারও বহিস্কাআদেশ উঠিয়ে সুজনকে স্বপদে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পদ ফিরে পাওয়ার পরেই আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেন সুজন। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক সদর উপজেলার একাধিক ছাত্রলীগের নেতারা জানায়, ছাত্রলীগ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন। এই সংগঠনে কোন অপরাধীদেরই ছাড় দেওয়া হয় না। সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদকের পদ পাওয়ার পরে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম করতে থাকেন সুজন। তাকে বহিস্কারের পরে তৃণমূলের ছাত্রলীগের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছিলো। কিন্তু পদ ফিরে পাওয়ায় পরে বিগত দিনের চেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন সুজন। রেনুপোনার সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি সহ এমন কোন অবৈধ কাজ নেই যা সুজন করেননি। দক্ষিণ বাংলার রাজনৈতিক অভিভাবক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহসহ দলীয় নীতিনির্ধারক ফোরামের কাছে আমাদের আকুল আবেদন যাতে সুজনের অপকর্ম তদন্ত করে দ্রুত কঠোর থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন সেরনিয়াবাত বলেন, ছাত্রলীগ কখনও অন্যায়কারীদের প্রশ্রয় দেয় না, এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে, এতে সুজন দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।