আসাদুজ্জামান শেখ ::
বরিশালের শীতের সকালটা ছিল শান্ত, স্বাভাবিক দিনের মতোই। কিন্তু কর্নকাঠি ও চরকাউয়ার মানুষ বুঝতেই পারেনি—তাদের পরিচিত গ্রামীণ পরিবেশকে ঢেকে রাখা ধূসর ধোঁয়ার বিরুদ্ধে আজ শুরু হতে যাচ্ছে এক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। সকাল থেকেই এলাকাজুড়ে তৈরি হতে থাকে অস্বাভাবিক নড়াচড়া। মুহূর্তেই চেনা পথে ঢুকে পড়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের গাড়িবহর। সাইরেনের শব্দে কেঁপে ওঠে আশপাশ। বুঝতে বেশি সময় লাগে না—আজই সেই দিন, যখন অভিযানের হাত পড়ছে বহুদিন ধরে চলা অবৈধ ইটভাটাগুলোর ওপর।
ধোঁয়ার নগরীর বিরুদ্ধে জনস্বাস্থ্যের লড়াই

গত কয়েক বছরে বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা এসব অনুমোদনহীন ইটভাটা শুধু মাটির স্তরকেই ক্ষতবিক্ষত করেনি; দূষিত করেছে বাতাস, হুমকির মুখে ফেলেছে মানুষের ফুসফুস। স্থানীয়দের অভিযোগ—শীতের আগমনীতে সকাল-সন্ধ্যা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় গ্রামগুলো। শিশু ও বয়স্কদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়ছে প্রতিদিনই।
এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই পরিবেশ অধিদপ্তর, সদর দপ্তর (ঢাকা)-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সাজ্জাদ জাহিদ রাতুলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় বুধবারের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে অংশ নেন বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম, জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক কাজী সাইফুদ্দীন এবং প্রসিকিউশন প্রদানের দায়িত্বে থাকা সহকারী পরিচালক মোঃ সোহেল মাহমুদ। শুধু তাই নয়—পুলিশ, ১০ এপিবিএন, ফায়ার সার্ভিস ও আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যদের উপস্থিতি অভিযানে যোগ করে বাড়তি গুরুত্ব।
ইটভাটার চিমনি ভাঙার মুহূর্ত—এক প্রতীকী দৃশ্য

অভিযান শুরু হতেই প্রথমে লক্ষ্যবস্তু করা হয় দুটি ড্রাম চিমনি ইটভাটা। দীর্ঘদিন ধরে কোনো অনুমোদন ছাড়াই চালু ছিল এগুলো। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে মুহূর্তেই এগুলো ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করে কর্মীরা। লোহার বড় হাতুড়ির শব্দে এলাকার নীরবতা যেন গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল ইটভাটার চিমনির মতোই।
চরকাউয়ার একজন বৃদ্ধ বলেন,

“এই ভাটা বন্ধ হলে আমাদের শ্বাসটা একটু স্বাভাবিক হবে। ঘরে ধোঁয়া ঢুকে নাতি-নাতনিরা কাশি থামাতে পারে না।”
এই কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়—এ শুধু ইটভাটা ভাঙার অভিযান নয়, মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইও।
সবচেয়ে বড় ভাটা—সবচেয়ে কঠোর ব্যবস্থা

সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি নেওয়া হয় ১২০ ফুট চিমনি বিশিষ্ট একটি বিশাল ইটভাটার বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরে এটি স্থানীয় পরিবেশকে সবচেয়ে বেশি দূষিত করার অভিযোগে ছিল আলোচনায়। ভ্রাম্যমাণ আদালত সাইট পরিদর্শন করে আইন অনুযায়ী ২ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে। জরিমানার পরও এখানেই থেমে থাকেনি অভিযান—চিমনিটি ভেঙে পুরো কাঠামোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিসের পানি—মুছে দেয় কাঁচা ইটের আশা
পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানি ছিটাতে শুরু করেন কাঁচা ইটের পাহাড়ে। অল্প সময়েই সেগুলো কাদায় পরিণত হয়।
ইটভাটার মালিকদের চোখে তখন হতাশা, আর এলাকাবাসীর চোখে স্বস্তি।
এ অভিযানের প্রতিটি ধাপ যেন জানান দিচ্ছিল—আইনকে অমান্য করলে আর দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই।
আইন শুধু কাগজে নয়—বাস্তবেও প্রয়োগ
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)–এর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত এ অভিযান শুধু আজকের জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও এক বড় বার্তা রেখে গেলো। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ভাষায়—
“জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকবে। কোনো অনিয়মই ছাড় দেওয়া হবে না।”
শেষ কথা: পরিচ্ছন্ন বাতাসই ভবিষ্যৎ
অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস করা মানে শুধু একটা ব্যবসা বন্ধ করা নয়; এটা এক অঞ্চলের মানুষকে ধোঁয়া-ধুলোর ভয়াবহতা থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা। বরিশালের এই অভিযানে ঠিক সেই মানবিক দায়িত্ববোধই সামনে এসেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে—এ অভিযান ছিল ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ। ভবিষ্যতেও জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও কৃষিজমি রক্ষায় এমন অভিযান আরও জোরদার করা হবে।







