 
	                            						চাকুরির মেয়াদ শেষ দুই মাস আগে। তবুও দায়িত্ব ছাড়েননি। নিজের চেয়ারে বসেই বহাল তবিয়তে ঘুষ বাণিজ্য চালাচ্ছেন। মসজিদ-মাদ্রাসার বরাদ্দেও বসাচ্ছেন ভাগ। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হোক বা অন্যকিছু তাতে তার কিছুই যায় আসে না। বরাদ্দের ৩০ থেকে ৪৫ ভাগ টাকা নিজ হাতেই কেটে রাখেন তিনি। এজন্য আছে নানা খরচের অজুহাত।
এই ঘুষ বাণিজ্যের নেপথ্যে শামছুল হক (৬০)। তিনি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক।
জানা গেছে, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তার চাকুরিজীবন শেষ হয়েছে। কিন্তু তিনি অফিস ছাড়েননি। নিজ চেয়ার-টেবিলে বসেই তিনি ঘুষ বানিজ্য করে চলছেন।
অভিযোগ রয়েছে, শামসুলকে টাকা না দিলে পিআইও অফিসের ফাইল নড়ে না। তার দাবি মেটালেই অসাধ্যকে সাধন করতে পারেন তিনি। শামছুল হকের এই কর্মকাণ্ডের অনুসন্ধান শুরু করে যুগান্তরের এ প্রতিবেদক। আর এই অনুসন্ধানেই বেড়িয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি প্রকল্প থেকে হিসাব রক্ষণ অফিস, স্ট্যাম্প, রেজুলেশন ও অফিস খরচের অজুহাতে শামসুল বরাদ্দের ৩০ থেকে ৪৫ ভাগ টাকা কেটে রাখেন। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নিয়ে বিপাকে পড়ছেন প্রকল্প সভাপতি ও সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, টিআর কর্মসূচির আওতায় উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের চতলাখালী গাজী আয়জদ্দিন মাস্টার বাড়ির জামে মসজিদ মেরামত প্রকল্পের জন্য ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা পেয়েছেন ৩১ হাজার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মসজিদ কমিটির সভাপতি এবং প্রকল্প সভাপতি ফোরকান শিকদার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাকে ফোন দিয়ে অফিসে নেয়। হিসাব নিকাশ করে আমাকে ৩১ হাজার টাকা দিছে। আমি জিজ্ঞেস করেছি, আর টাকা? তিনি (শামসুল) বলেন, এটা আমাদের অফিসের খরচ। পরে আমি চলে আসছি।’
শুধু কি একটি প্রকল্পে এমন ঘটনা? না, এবিষয়ে আরও অনুসন্ধান করে যুগান্তর।
সোমবার দুপুরে পিআইও অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অবসরে যাওয়া অফিস সহকারি শামসুল হক নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছেন।
এসময় বরাদ্দের টাকা কম দেওয়া নিয়ে শামসুলের সঙ্গে মৌডুবি ভূইয়াকান্দা জামে মসজিদ সংস্কার প্রকল্পের সভাপতি মাসুদ রানার কথা কাটাকাটি হচ্ছিল।
জানতে চাইলে মাসুদ রানা বলেন, রবিবার পিআইও অফিসের সহকারি শামসুল আমাকে ২১ হাজার টাকা দিয়েছে। অথচ মসজিদের বরাদ্দ ছিল ৩৭ হাজার টাকা। আমি জানতে চেয়েছি ১৬ হাজার টাকা গেল কই? আমাকে কিছু না বলে সে বলছে, আপনি এখন যান, এই টাকাই। বিষয়টি আমি পিআইও স্যারকে জানালে আজ (সোমবার) আমাকে ১২ হাজার টাকা ফেরত দেয়। কিন্তু মোট বরাদ্দের ৪ হাজার টাকা খরচ বাবদ রেখে দিছে।’
কথা হয় ছোটবাইশদিয়া সোহেল দফাদার বাড়ির মসজিদের প্রকল্প সভাপতি সোহেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার মসজিদের বরাদ্দ ৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু আমাকে দিয়েছিল ৩২ হাজার ৫০০ টাকা। পরে পিআইওকে কে বা কারা অবগত করার পর শামসুল সাহেব বাজারে এসে আরও ৮ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে যায়। তবুও ৪ হাজার টাকা খরচ বাবদ রেখে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘বরাদ্দের টাকা আনতে পিআইও অফিসে গিয়ে দেখলাম, অন্যান্যদের কাছ থেকেও ৩০%-৪৫% যার কাছ থেকে যেরকম খুশি টাকা রেখে দিচ্ছে। এভাবে হলেতো অফিসের টাকা দিয়ে প্রকল্পের কাজ করা সম্ভব হবে না।’
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচিতে দ্বিতীয় পর্যায় উপজেলার মসজিদ ও মাদ্রাসাসহ ২২টি প্রকল্পের জন্য ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৪৮৯ টাকা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় ৮টি প্রকল্পে ২৩ লাখ ৬৪ হাজার ২১৪ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
পিআইও অফিসে শামসুলের এ ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি ওপেনসিক্রেট। তবুও অনেকে মুখ খুলতে নারাজ। কারণ তাহলে ফাইল আটকে যেতে পারে শামসুলের টেবিলে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এসব শামসুল করছে। তার বিরুদ্ধে তো আমরা কথা বলতে পারি না। যা খুশি তাই করছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিআইও অফিসের এক কার্যসহকারি বলেন, ‘টাকা দেয়, কিছু টাকা রাখে মাষ্টাররোলের।’
এবিষয়ে অভিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত পিআইও অফিসের অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক শামসুল হক বলেন, ‘আমারে আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করো। যা বলার পিআইওরে বল। আমি মাফ চাই। এগুলো আমার মত চুনোপুটির সঙ্গে আলাপ করে কোন লাভ আছে?।’
এবিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এই মুহুর্তে অফিসের কার্যক্রম চালানোর লোক নেই। জুন পর্যন্ত শামসুল সাহেবকে রাখা হয়েছে। তবে তিনি অফিসে এ ধরণের কর্মকাণ্ড করে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
 
        

 
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        
 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                        