#

বরিশালের উজিরপুরে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার (ইউপি সদস্য) অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগের সূত্র ধরে সরকারি কাজের টাকা ভাগাভাগির কথোপকথন ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

#

উজিরপুর উপজেলার ৩ নম্বর জল্লা ইউনিয়নের এ ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।

এরইমধ্যে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নজরেও এসেছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন তারা।
যদিও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদারের সঙ্গে সংরক্ষিত ওয়ার্ড মেম্বার দিপালী হালদারের ১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের মোবাইল কথোপকথনটি কীভাবে ফাঁস হয়েছে তা নিশ্চিত হতে না পারলেও সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে মোবাইলে ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কথোপকথন থাকা কণ্ঠ তার বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি যে কথোপকথন হয়েছে তা সত্য জানিয়ে রেকর্ডটির বিষয়ে তিনি বলেন, ওই মোবাইলটি তার ছেলের কাছে ছিলো, তার কাছ কে যেন মোবাইলটি নিয়ে কী করেছে তা বলতে পারছি না।

কথোপকথনে সরকার হতদরিদ্রের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পের (৪০ দিনের) কাজ না করিয়ে টাকা তুলে নেওয়ার পরে তা ভাগবাটোয়ারার বিষয়টি স্পষ্ট। একইসঙ্গে চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা প্রশাসনকে ঘুষ দেওয়ার পরও কেন ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে তা জানতে চাওয়া নিয়ে তর্কের বিষয়টি স্পস্ট।

তবে উত্তরের প্রথমে চেয়ারম্যান বলেছেন, টাকা পয়সার কোনো বিষয় নয়, খারাপ ব্যবহার ও আচরণ ভালো না হওয়ার বিষয় নিয়ে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণতি বিশ্বাস জানান, ফাঁস হওয়া কথোপকথনের খবর শুনেছেন তিনি। কিন্তু সেখানে মেম্বার-চেয়ারম্যান কী নিয়ে আলাপ করেছেন তা শুনেননি। অডিও রেকর্ডটি শুনে কোনো বিষয়ে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।

কথোপকথনে ইউএনওকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে যা বলা হয়েছে সেই সর্ম্পকে জানতে চাইলে প্রণতি বিশ্বাস বলেন, উজিরপুর উপজেলায় এমন ঘটনা এটাই প্রথম। আমার বিরুদ্ধে পেছনে বসে কেউ কিছু বললে সেটিতো সত্য হয়ে যাবে না।

ইউএনও বলেন, ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শওকত আলী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন, তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। সেই অভিযোগের তদন্ত চলছিল। আপনি জেনে অবাক হবেন, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ‘এক কথায় অমায়িক লোক’। এক প্রতিবন্ধীর সার্টিফিকেট আনতে গিয়েছিলেন দিপালী হালদার, তাকে সার্টিফিকেট দেননি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তখন দিপালী হালদার তাকে মারধর করতে উদ্যত হন। বিষয়টি জেনে আমি পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করি। সেই ঘটনার তদন্ত চলছে।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শওকত আলী গত বছরের শেষ দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন জল্লা ইউনিয়নের সংরক্ষিত (৪, ৫ ও ৬) ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে। সেখানে তিনি দিপালী হালদারের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনেন।

আর ইউপি সদস্য দিপালী হালদার প্রতিবন্ধী ভাতার সার্টিফিকেট নিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন বলে জানিয়েছেন ডা. শওকত আলী। এ ঘটনার পর কয়েকজন ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার অনাস্তা পত্র দেন ইউএনওর কাছে।

১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের ফোনালাপের চুম্বুকাংশ বাংলানিউজের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:

ইউপি সদস্য দিপালী হালদার: মামী আপনি শুধু শুধু মেম্বারদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে যে কমপ্লেইন দিলেন, আর আপনিও সই দিলেন, এটা ভালো হইলো?’

চেয়ারম্যান বেবী হালদার: মানে কি, তুমি আমারে দোষো কেনো, খালি খালি কমপ্লেইন দিছি মেম্বারদের দিয়া, এডা কেমন কথা?

দিপালী হালদার: এহন শোনেন, আপনে যে টাকা চাইছেন আমার কাছে, আমি দিছি না আপনারে? ৭০ হাজার টাকা দিছি, আগেরবার কর্মসূচির দিছি ৫০ হাজার টাকা। তাইলে আমি কি আপনারে কম দিছি টাকা বলেন?’ আমি কর্মসূচির টাকা দিছি ৭০ হাজার, আপনি সেটা বলবেন না ইউএনওকে?

বেবী হালদার: বলেন, ‘৭০ হাজার দেও, আর তুমি ৯০ হাজার দেও, সেটা কোনো বিষয় না। তোমার আসবে কত? হিসাব থাকতে হবে, কত টাকায় কত আসবে। ৭০ হাজার, আর ৯০ হাজারের কোনো প্রশ্ন না এখানে। ’

দিপালী হালদার: না…আপনি কইছেন তোমার উপজেলা চাইছে ৪০ হাজার, আর…দিছি এতো, এটা বলে কইছেন ১ লাখ টাকা। এহন আমি আপনারে ৭০ হাজার টাকা দিছি, আগের বিলে দিছি ৫০ হাজার টাকা।

বেবী হালদার: কিসের তোমার ১ লাখ টাকা? তোমার কত পারসেন্ট আসবে সেটা জানে সচিব, তা তো আমিও জানি না এখনও। আর উপজেলা দিয়া ধরছে তোমার এবং চেয়ারম্যানের দুইডা প্রজেক্টে তাদের বেশি অভিযোগ, আর সব প্রজেক্ট তো দেখে নাই সেদিন। তারা ৩ থেকে ৪ টা প্রজেক্ট দেখছে, তার মধ্যে এ দুটা প্রজেক্টে বেশি অভিযোগ তাদের। পিআইও (অয়ন সাহা) লিখে দিছে, চেয়ারম্যানের প্রজেক্টে ১ লাখ ১০ হাজার, আর তোমার প্রজেক্টে দিছে ৯০ হাজার। এ দুইটা প্রজেক্ট দিয়া আমরা এইডা…দাবি করি। আর অন্য প্রজেক্ট বাদ-ই দিলাম, এইডা আমরা দাবি করি, এ ২ লাখ টাকা। তো অন্যান্য মেম্বাররা, তারা যে হ্যারা ১০/১৫ হাজার করে দিছে, হেইতো ভালো। এখন আমি তো…এরপরে সবাই মিলে আমারে ধরছে ৭০ হাজার, তোমারে ধরছে কত, ৫০ না, জানি কত হাজার।

দিপালী হালদার: আমারে টাকা ধরছে কে, আপনি?

বেবী হালাদার: সবাই মিলে, সব মেম্বাররা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে, যার যার কাজের মানের ওপর নির্ভর করে। দুটি প্রজেক্টের ওপর বেশি অভিযোগে। আমি চেয়ারম্যান বিধায় আমাকে বেশি ধরছে। আমারে একারে ধরছে ৭০ হাজার, আমি সেই ৭০ হাজার টাকা দিয়ে দিছি, একেবারে নগদ দিছি… সচিবের কাছে ৭০ হাজার টাকা জমা। ……..আর উপজেলার টাকার সঙ্গে পারসেন্টের টাকার কি যোগাযোগ, তুমি আগে পারসেন্ট বাবদ ৫০ হাজার টাকা দিয়া দিছো। আর জেয়ারে (পরে) ২০ হাজার টাকা ভাগে ভাগে দিছো, এখন তোমার কাছে পারসেন্টের হিসাবে আরও পায়।

দিপালী হালদার: আমি ওই কাজে মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিছি, আর কত দিবো?

বেবী হালদার: আমি চেয়ারম্যান হইয়া আমি ৭০ হাজার টাকা দিতে পারছি, আমার স্বামী (নিহত চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালাদার নান্টু) এতো টাকা ঋণ-দেনা রেখে গেছে, ব্যাংকে…বাড়ি-ঘর সব। আমি হ্যা দিতে পারছি, আমি চেয়ারম্যান হইয়া। আর তোমরা মেম্বার হইয়া দিতে পারবা না, তোমরা উপজেলায় গিয়া বুঝবা, এইখানে বুঝবা, ওইখানে বুঝবা। বেশ বোঝো, সমস্যা কি?

দিপালী হালদার: আমাদের কাজ ভালো না হলে তারা (উপজেলা প্রশাসন) বিল দিবে না, কিন্তু ইউএনও, পিআইও আমাদের কাছে এতো টাকা চায় কেন? এগুলো আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন না।

বেবী হালদার: বলতে পারি না …আবার, বলছি না। সব ইউনিয়ন থেকেই নিছে, যে যে ইউনিয়নের কাজের মান ভালো না, সবাইই দিছে, কম আর বেশি। এখন.. জল্লা ইউনিয়নের কাজ যথেষ্ট খারাপ কইছে। জল্লা থেকে ২ লাখ টাকার কম তারা (উপজেলা প্রশাসন) নিবেই না, আমি দেড় লাখ টাকা নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে ঘুরতেছি। তারা (উপজেলা প্রশাসন) কোনো টাকাই ধরে না, ২ লাখ টাকার এক টাকাও কম নিবে না। ইউএনওর থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত টাইম নিছিলাম, যে এর মধ্যে টাকা দিয়ে দিবো। শেষে আমারে ইউএনও পর্যন্ত ধরছে সেই টাকার জন্য। আগে তো…পিআইওর সঙ্গে সচিবের কথা হতো। আমার সঙ্গে বেশি কিছু বলে নাই। এখন তো ইউএনও সরাসরি সেদিন আমারে ধরছে, যে আপনি সেই টাকা কবে দিবেন? আপনি তারিখ দেন কবে দিবেন। আমি তারিখ দিয়ে আসছি, গত সপ্তাহের মধ্যে। কিন্তু সেই তারিখ তো শেষ, এখন এই সপ্তাহও যায়। তারা (উপজেলা প্রশাসন) এক টাকাও কম নেবে না।

তবে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রাণী হালদার। তবে তার দাবি কণ্ঠ নকল করে অডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অয়ন সাহা বলেন, অনিয়মের অভিযোগে বেশ কয়েকটি কাজের টাকা আমরা আটকে দিয়েছি। টাকা লেনদেনের বিষয়ে তিনি কোনো ঘুষ নেননি বলেও জানান।

উজিরপুর উপজেলার ৩ নম্বর জল্লা ইউনিয়নের ৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৪১ জন শ্রমিকের কাজের জন্য ২৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে ওই ইউনিয়নের সবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে কাজ না করে টাকা নিয়ে গেছে জনপ্রতিনিধিরা। ঘুষের সেই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে এ কথোপকথনটি ফাঁস হয়।

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here