নিজস্ব প্রতিবেদক //বরিশাল গণপূর্ত বিভাগ এখন আর উন্নয়ন বাস্তবায়নের দপ্তর নয়, এটি পরিণত হয়েছে দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির নিরাপদ ঘাঁটিতে। সেই ঘাঁটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন হিসাব সহকারী আবুল হাসান রুপক। একটি সাধারণ হিসাব সহকারী পদে থেকে কীভাবে কেউ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়, তার জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছেন তিনি।
প্রায় ১৬ বছর ধরে একই দপ্তরে বহাল থাকা রুপকের কোনো বদলি না হওয়া শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং প্রভাবশালী দুর্নীতির শক্ত ভিত্তির প্রমাণ। বছরের পর বছর একই চেয়ার আঁকড়ে ধরে তিনি গড়ে তুলেছেন অর্থ, ক্ষমতা ও ভয়ভীতির এক অদৃশ্য সাম্রাজ্য।
স্বৈরাচারী আমলে সম্পদের বিস্তার, এখন রাজনৈতিক রঙ বদল।
স্বৈরাচারী সরকারের সময় গণপূর্ত বিভাগের হিসাব সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে করতেই রুপক গড়ে তোলেন বিপুল অবৈধ সম্পদ। সরকার পরিবর্তনের পর নিজেকে ছাত্রদলের সাবেক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করে সেই অতীত ঢাকার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় বদলালেও অর্থের উৎস বদলায়নি।
কমিশন নির্ভর বিল ছাড়, ঠিকাদাররা জিম্মি।
বরিশাল গণপূর্ত বিভাগে কাজ শেষ মানেই বিল পাওয়া নয়। অভিযোগ অনুযায়ী, নির্ধারিত কমিশন না দিলে ফাইল আটকে রাখা হয়, বিল ঝুলে থাকে মাসের পর মাস। কাউকে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে হয়রানি করা হয়। এই পদ্ধতিতেই ঠিকাদারদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জুন এলেই ভাউচার আর লুটপাটের উৎসব
প্রতিবছর জুন মাস এলেই শুরু হয় ভুয়া ভাউচারের মহড়া। অভিযোগে উঠে এসেছে, নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগসাজশে অবৈধ ভাউচার তৈরি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। পিপিআর আইন অনুযায়ী ৩০ জুনের মধ্যে বিল পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নিয়মিতভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
একই কাজ বারবার দেখিয়ে টাকা তোলা
এমবি বইয়ে একই রড, একই ঢালাই, একই গাঁথুনি একাধিকবার দেখিয়ে অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট করে। দুর্নীতি এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে যে অডিট ব্যবস্থাও অর্থের বিনিময়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্ত্রীর নামে সম্পদ, তথ্য ফাঁস হতেই স্ত্রী অস্বীকার
অভিযোগ অনুযায়ী, রুপকের অবৈধ সম্পদের বড় অংশই স্ত্রীর নামে। নগরীর সদর রোডের কাকলীর মোড় এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের স্টল বরাদ্দ নিয়ে তা বেআইনিভাবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। একাধিক ফ্ল্যাট, জমি ও স্থাবর সম্পত্তি স্ত্রীর নাম ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এসব তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই স্ত্রীকে অস্বীকার করার অপচেষ্টা দুর্নীতি আড়ালের মরিয়া কৌশল বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বরিশাল থেকে ঢাকা পর্যন্ত সম্পদের বিস্তার
রুপকের নামে ও বেনামে বরিশাল জর্ডান রোডে একাধিক ফ্ল্যাট, ঢাকায় ফ্ল্যাট, রূপাতলীতে জমি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বাড়ি, ভোলা ও বাকেরগঞ্জে জমি ক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে। একজন হিসাব সহকারীর আয়ের সঙ্গে এসব সম্পদের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
দুদকের নীরবতা বড় প্রশ্ন
লিখিত অভিযোগ, নথিপত্র ও সম্পদের তথ্য থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এই নীরবতা সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাই যদি নিশ্চুপ থাকে, তাহলে এই লুটপাট বন্ধ হবে কীভাবে।
বরিশাল গণপূর্ত বিভাগ আজ উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং লুটপাটের প্রতিচ্ছবি। আর সেই লুটপাটের অন্যতম প্রধান কারিগর হিসাব সহকারী আবুল হাসান রুপক। প্রশাসনের নীরবতা ও দুদকের নিষ্ক্রিয়তা এই দুর্নীতিকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে।
এখন প্রশ্ন একটাই, এই দুর্নীতির দেয়াল ভাঙবে কে, নাকি সবকিছু জেনেও সবাই নীরব থাকবে।







