TT Ads

 

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় নাম জড়ানোর পর অনুশোচনা কিংবা আত্মগোপন কোনোটিই নয়। বরং আরও দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বাচ্চু মিয়া। অভিযোগ উঠেছে, দুদকের জালে ধরা পড়ার পর তিনি উল্টো ঘুষের হার বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতে এলজিইডির আওতাধীন প্রকল্পে কাজ করা ঠিকাদারদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অনুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্র, অডিও রেকর্ড, ডিজিটাল চ্যাট ও মাঠপর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে টেন্ডার বণ্টন, কাজ প্রদান, বিল ছাড় ও অর্থ মঞ্জুরি—প্রতিটি স্তরেই চলছে পরিকল্পিত দুর্নীতি, ঘুষ আদায় ও কমিশন বাণিজ্য। এলজিইডির ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয় কার্যত একটি নিয়ন্ত্রিত দুর্নীতির নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে, যার কেন্দ্রে রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী বাচ্চু মিয়া।
কাজ না করেই কোটি টাকার বিল
রাজধানীর গাবতলী এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ প্রকল্পে অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে ভয়াবহ অনিয়ম। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান। অথচ কাগজপত্রে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে বিল পাইয়ে দিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বাচ্চু মিয়া।
এই অনিয়মের বিষয়টি শুধু অভিযোগে সীমাবদ্ধ নয়। দুদকের তদন্তেও এর সত্যতা উঠে এসেছে। তদন্তে দেখা যায়, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া মেজারমেন্ট বুক তৈরি করা হয়। সেই মেজারমেন্ট বুক ব্যবহার করেই বাস্তবে কাজ না করেই সরকারি কোষাগার থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় কমিশনের বিনিময়ে সরাসরি সহায়তা দেন নির্বাহী প্রকৌশলী বাচ্চু মিয়া।
মামলার পর তড়িঘড়ি নির্মাণ
দুদকের মামলা হওয়ার পর প্রকল্প এলাকায় শুরু হয় অস্বাভাবিক তৎপরতা। সেন্টারিং না খুলেই একসঙ্গে তিনটি ছাদের ঢালাই দেওয়া হয়। একই সঙ্গে চলতে থাকে ইটের গাঁথুনি, প্লাস্টার ও বৈদ্যুতিক পাইপলাইন স্থাপনের কাজ। এতে নির্মাণকাজের মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। প্রকৌশল বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের কাজ ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
টেন্ডার আগেই বিক্রি, ঘুষের তালিকা
অনুসন্ধানে পাওয়া ডিজিটাল আলামতে দেখা যায়, টেন্ডার আহ্বানের আগেই নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের কাছে অর্থের বিনিময়ে দরপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঘুষ আদায়ের জন্য ঠিকাদারদের নাম, মোবাইল নম্বর ও অর্থপ্রদানের হিসাব সংরক্ষণ করে নজরদারি চালানো হতো। টাকা না দিলে কাজ বাতিল, বিল আটকে রাখা কিংবা ছোটখাটো ভুল দেখিয়ে হয়রানির অভিযোগও রয়েছে।
নিজের ভাইয়ের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান
অভিযোগ রয়েছে, নির্বাহী প্রকৌশলী হওয়ার পর নিজেই নামে-বেনামে একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন বাচ্চু মিয়া। তার ছোট ভাই শহিদুল ইসলাম সুমনের নামে করা দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় এক কোটি টাকার কাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে লাইসেন্সে উল্লেখিত ঠিকানায় গিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগ স্পষ্ট।
ঘুষের হার বাড়িয়ে দ্বিগুণ চাপ
ঠিকাদারদের ভাষ্যমতে, আগে কাজের মোট টাকার আট শতাংশ ঘুষ দিতে হলেও দুদকের মামলার পর সেই হার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এর বাইরে বিল ছাড়ের সময় আরও চার থেকে পাঁচ শতাংশ আদায় করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে ঠিকাদারদের হাজির হতে বাধ্য করা হতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। মামলা হলেও ঘুষ বাণিজ্যে কোনো ভাটা পড়েনি, বরং আরও সংগঠিত রূপ নিয়েছে।
ক্যামেরা দেখেই আতঙ্ক
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে এলজিইডি কার্যালয়ে গেলে ক্যামেরা দেখেই অস্বস্তিতে পড়েন নির্বাহী প্রকৌশলী বাচ্চু মিয়া। তার সহযোগীরা ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। পরে তিনি অভিযোগের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
দুদকের তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় এখনও স্বপদে বহাল রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী বাচ্চু মিয়া। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বলতে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করলেও চার মাস পার হলেও সেই প্রতিবেদন প্রকাশ পায়নি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—তদন্ত কি কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি আদৌ কোনো জবাবদিহি হবে?

TT Ads